প্রাক্তন

Minhaz Fahme
16 min readJul 26, 2022

--

**reader discretion is advised**

বীভৎস সব মৃতদেহ ডিউটির কারণে কম দেখা হয়নি এ জীবনে, তবুও এই লাশটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে এক রকম গা গুলিয়ে আসতে লাগল শরীফের। দম আটকে নাকি রক্তক্ষরণে মৃত্যু সেটা পরে নিশ্চিত হওয়া যাবে- পোস্টমর্টেমের পরে অবশ্যই। কিন্তু ইন্টেলিজেন্স অফিসার শরীফের অভিজ্ঞতা বলছে এ দুটোর মধ্যে যেকোন একটা। কিংবা দুটোই। বেশিক্ষণ তাকানোর প্রয়োজন পড়ে নাই ভাগ্য ভাল। লাশ ইন্সপেকশনের পর দ্রুতই খুনীর ফেলে যাওয়া কোন আলামত সন্ধানে ব্যতিব্যস্ত হতে গেল শরীফ। কিন্তু বসের ফোন চলে এসেছে এরমধ্যে।
“স্যার, সালাম স্যার।”
“ওয়ালাইকুম। কী শরীফ সাহেব, এক্কেবারে আর্টিস্টিক মার্ডার কেস পেয়েছ দেখছি! জিহ্বা, আর হাত দুটোই কেটে ফেলেছে দেখলাম!”
এখনকার দিনে সব ক্রাইম সীন ইনভেস্টিগেশন লাইভ ক্যামেরায় রেকর্ড হয়। তবে বস অন্য সব কাজ ফেলে শরীফের এই ইনভেস্টিগেশন দেখছেন ব্যাপারটা খানিক আজবই ঠেকল, কিন্তু প্রকাশ করল না সেটা শরীফ। নতুন পোস্টিং হয়ে এসেছেন এই বস, মাইক্রোম্যানেজ করার বাতিক থাকতেই পারে, কে জানে! এখতিয়ার তো আছে, তবে অকারণে নাক গলাবে না বেশি এটাই আশা করতে পারে সে।
“জ্বি স্যার, জিহ্বা আর হাত ধারালো কিছু দিয়ে কেটেছে। কেটে সেগুলো গিলতে ফোর্স করেছে ভিকটিমকে। আমার ধারণা দম আটকে মারা গেছে, কিংবা রক্তক্ষরণে।”
“হুম, নাইস অবজার্ভেশন। পোস্টমর্টেম শেষে বোধহন নিশ্চিত হওয়া যাবে, তাইনা? আচ্ছা, কোন আলামত পেলে?”
“না স্যার, এখন খুঁজবো।”
“ওকে, বেস্ট অব লাক, আই উইল গেট আউট অব ইয়োর হেয়ার দেন।”
“জ্বি স্যার, গুডবাই স্যার।”
খুঁজে খুব একটা লাভ হলো না যদিও। খুনী সম্ভবত খুবই প্রফেশনাল ছিল, কারণ ছাপ কিংবা সিসিটিভি ফুটেজ কিছুই নাই। আলামত বলতে কেবল একটা জিনিস পাওয়া গেছে, লাশের কাছেই পড়ে ছিল। একটা অনেক পুরনো মিউজিক প্লেয়ার। এধরনের জিনিস চলে না বেশ অনেক বছর হয়ে গেল। অন করে প্লে বাটন চাপ দিল শরীফ।
“সেদিন ভোরে, বুকের গভীরে-
শুনেছি জমে থাকা নীল বেদনারা ডাকে,
এই শহরে ইটের পাহাড়ে-
ছিলো না কেউ যে দেওয়ার প্রেরণা…
যন্ত্রে বাঁধা মন, ছিলো ক্লান্ত অসহায়-
অর্থে কেনা সুখ, ম্রিয়মান দুঃখের ছায়ায়…”
ওয়ারফেজের ক্ল্যাসিক গান পূর্ণতা। দু দশক ধরে ওয়ারফেজের সর্বাধিক জনপ্রিয় গান হিসেবে আছে সম্ভবত। আর কোন গান নেই প্লেয়ারটিতে। পুরো বাসা আধুনিক সব জিনিসপাতি দিয়ে ভর্তি। এর মাঝে এই একটা গান ভর্তি এক যুগ আগের মিউজিক প্লেয়ার ঠিক যাচ্ছে না। আর প্লেয়ারে কোন হাতের ছাপও নেই। তারমানে পুরো বাসায় যে ছাপ সরিয়েছে, সেই এটা থেকে সরিয়েছে। এই একটা ক্লু নিয়ে অফিসের দিকে রওনা দিল শরীফ। লাশের ছবিটা মাথা থেকে সরিয়ে ফেলতে গেল, মাথায় উড়ে এসে জুটল গানের চিরপরিচিত লিরিক্স-
“আর নয় সময় উদ্দেশ্যহীন মিছিলে
তুমি সেই পূর্ণতা আমার অনুভবে
আর নয় আঁধার, তুমি স্বপ্নে ডেকে নিলে
ভরে মন অন্তহীন রঙিন এক উৎসবে”
আসার পথে চীজ কিনে নিয়ে যেতে হবে বাসায়। আজ পিজ্জা দিবস। সপ্তাহের এক এক দিন এক এক রকমের ডিশের রুটিন চলে শরীফের বাসায়। আর আজকের পিজ্জাটা বানানোর ভার শরীফের। মাসে দুদিন শরীফ বানায়, আর দু দিন শান্তা- তার স্ত্রী। সংসারের কাজ মিলেমিশেই করে দুজন। সুপারশপ থেকে বের হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল শরীফ। ফ্যামিলি টাইম আজ যা নেবার নিয়ে নিতে হবে, এ কেসটা বেশ ভোগাবে বলে মনে হচ্ছে।
দুদিন পর বস ডাকলেন অফিসে।
“কী শরীফ সাহেব? কেস সলভড নাকি?”
“নাহ স্যার, হাবুডুবু খাচ্ছি।”
“প্রেমে? এই বয়সে?”
“নাহ স্যার, বয়েস থাকলেও সম্ভব না। বউ বাচ্চা আছে হাহা।”
“হু, তোমার যেরকম নামডাক- আগে আগে বিয়ে করে ভালোই করেছো। তোমাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি চলত নাহলে এখনও।”
“সে এখনও একেবারে চলে না সে ঠিক না স্যার। হাহা। স্যার, একটু ক্রিটিক্যাল মনে হচ্ছে কেসটা। ভিকটিম এর ধন সম্পদ ভালোই ছিল। কিন্তু সে জন্যে খুন হয়নাই নিশ্চিত। কারণ কোন কিছু নিয়েছে বলে মনে হয়না। ব্যাংক একাউন্টও ঠিকঠাক।”
“কোন শত্রু ছিল না?”
“সেটাই খুঁজছি স্যার। খুনটা দেখে মনে হচ্ছে প্রচণ্ড ক্ষোভ থেকে হত্যা।”
“সে তো ঠিক আছে। কিন্তু হাত আর জিহ্বা?”
“সিম্বলিক। খুনী কিছু একটা বলতে চেয়েছিল বোধহয়।”
“র‍্যান্ডম ও তো হতে পারে।”
“মনে হয় না। খুবই আনলাইকলি না?”
“হু। যদি না সে এইভাবে খুন করে অভ্যস্ত হয়ে থাকে।”
“কিন্তু স্যার, কাজ দেখে তো মনে হল কোন প্রফেশনালের কাজ, কোথাও কোন ছাপ পেলাম না।”
“সেটা জানি, দেখো তাহলে মোটিভ খুঁজে কিছু বের করতে পারো কিনা-”
ফোন বেজে উঠল শরীফের। বস ইশারা করলেন রিসিভ করতে।
কোন কথা না বলে চুপচাপ শুনল কিছুক্ষণ শরীফ।
“ওকে আমি আসছি”, বলে রেখে দিল একটু পর।
“স্যার, আরেকটা খুন হয়েছে। শহরের অন্য মাথায়। কিন্তু সিমিলার প্যাটার্ন। এবারের জনকে একগাদা কাগজ গিলিয়ে মেরেছে।” বলতে বলতেই কপালে ভাঁজ পড়ল শরীফের।
চোয়াল ঝুলে পড়ল বসের। “বলো কী?”
“জ্বি স্যার। গতকালই আবিষ্কার হয়েছে লাশ। সিমিলার কেস এখানে চলছে জেনে নক করল আমাকে।”
“ঠিক আছে, দেখে আসো তাহলে।”
“জ্বি স্যার।”
দরজা পর্যন্ত গিয়ে পেছনে তাকাল শরীফ।
“স্যার, লাশের সামনে এবারও আরেকটা মিউজিক প্লেয়ার পাওয়া গিয়েছে।”
“বলো কী?”
“জ্বি স্যার, একটা গান এবারও। Lost On You বাই LP”
“ইউ মীন তোমার ফোনের রিং টোনে যে গানটা শুনলাম সেটা?”
“জ্বি স্যার।”

পর্ব ২ — Lost On You

আগের ভিকটিম কর্পোরেট চাকুরিজীবি ছিলেন, আর এবারের জন লেখক। দুজনের মধ্যে কোন কিছুইতেই কোনরকম মিল নাই। আগেরজনের পরিবার ছিল, আর নতুন ভিকটিম একেবারেই একা। পরিবারের সাথে তেমন কোন যোগাযোগ না থাকলেও, ফ্যান ফলোয়ারের অভাব ছিল না। মোটামুটি বিখ্যাত ছিলেন দেশজুড়ে। নারীভক্তদের সাথে ঘনিষ্ঠতার গুজবও প্রচলিত ছিল বেশ। তাদের মধ্যে কারো মোটিভ আছে কিনা বের করতে বেশ বেগ পেতে হবে, কারণ লিস্ট অনেক লম্বা, আর সব রোম্যান্টিক সম্পর্ক খুঁজে পাওয়াও মুশকিল। যদি খুনী এদের মধ্যে কেউ হয়ে থাকে, আর সম্পর্কটা যদি গোপন কিছু হয়ে থাকে, তবে সে সম্পর্কে জানা একমাত্র জীবিত ব্যক্তি হচ্ছে খুনী স্বয়ং। তবে লেখক সাহেবের ভক্তদের মধ্যে কমবয়সী মেয়েরাই অধিক, এরকম প্রফেশনাল কিলিং এদের দ্বারা সংঘটিত হওয়া একটু অসম্ভবই। লেখকের লেখার খাতাগুলোই তার গলা দিয়ে জোর করে ঠেসে নামানো হয়েছে। যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু। যে শব্দগুলো হাজার হাজার মানুষের অন্তরের সুখ এনে দিয়েছে, সেগুলো দিয়েই শব্দের স্রষ্টাকে মেরে ফেলা হল।

সব তথ্যাদি বের করতে করতে বেশ দেরি হয়ে গেল শরীফের। বস ছাড়া আর সিনিয়র কেউ নেই স্টেশনে। বস অফার দিলেন বাসায় ড্রপ করে দেবার, মানা করলো না শরীফ। সারাদিন অনেক খাটনি গিয়েছে, একটু রিফ্রেশিং কিংবা ভিন্ন আলোচনা দরকার।

কিন্তু গাড়িতে উঠার পর আলোচনার বিষয়বস্তু শরীফের মনঃপূত হল না।

“কী, শরীফ সাহেব? দুই ভিকটিমের মধ্যে মিল কিছু পেলে?”

“স্যার, হত্যার প্যাটার্ন এই যা একটু মিল আছে, কিন্তু এ দুজনের মধ্যে তো কোন সম্পর্কই নেই। আলাদা খুনীও হতে পারে। ইন্সপায়ার্ড কিলিং।”
“হুম, তবে একই খুনীও হতে পারে তাহলে?”
“ফার শট, বাট ইয়েস স্যার, সম্ভাবনা আছে। যদি তাই হয় তবে মনে হচ্ছে সিরিয়াল কিলিং।”
“তারমানে আরও হবে বলতে চাচ্ছো?”
“জ্বি স্যার, আমি তাই ভাবছি।”
“আর এ সবের সাথে তোমার রিংটোনের সম্পর্ক কী বলো তো।”

একটু থেমে গেল শরীফ।
“স্যার, ব্যাপারটা একটু বেশি কাকতালীয় ছিল, কিন্তু এই গানটা ওই ব্যান্ডের সবচেয়ে জনপ্রিয় গান, বেশ কবছর আগেও লোকে অনেক শুনত।”
“শুনো, কাকতালীয় ব্যাপারের কোন বেশি কম নেই। আর কোন ঘটনাই কারণ ছাড়া ঘটে না। এখন গানটা শুনি চলো”
পুলিশের গাড়িতে উচ্চ ভলিউমে বাজতে থাকল Lost On You.

When you get older, plainer, saner
Will you remember all the danger
We came from?
Burnin’ like embers, falling tender
Long before the days of no surrender years ago
And well you know?

So smoke ’em if you got ‘em
’cause it’s going down
All I ever wanted was you-
I’ll never get to heaven,
’cause I don’t know how..

Let’s raise a glass or two-
To all the things I’ve lost on you…
Tell me are they lost on you?
Just that you could cut me loose,
After everything I’ve lost on you..

“স্যার, আপনি কখনও ক্যারিয়ারে কোন কিলার পেয়েছিলেন যে কিনা প্রফেশনাল মিউজিশিয়ান?”
বাড়ির কাছে এসে প্রশ্নটা করল শরীফ।
“হ্যাঁ, কয়েকবার দেখেছি এরকম। তবে হয় এক্সিডেন্টাল কিলিং ছিল, নয়তো নেশার ঘোরে। দু একবার ব্যক্তিগত কারণেও হতে দেখেছি, তবে কোনটার দোষই মিউজিককে দেয়া যাবেনা। ”
“মিউজিক প্লেয়ারগুলোর অরিজিন নিয়ে কিছু পেলে?”
“না স্যার, ডেড এন্ড। শেষ যে মালিকের সন্ধান পাওয়া গেছে সেই পারচেজ হয়েছে অনেক আগে। সম্ভবত ক্যাশ স্টোর থেকে নেওয়া। ”
“হুম। তারমানে বলছো যে যদি সিরিয়াল কিলার হয় তাহলে পরের টার্গেট কে হতে পারে সে বিষয়ে আমাদের কোন ধারণাই নেই?”
“না স্যার। উই বেটার হোপ দ্যাট দিস ইজ নট আ সিরিয়াল কিলিং। চলে এসেছি, স্যার। আমাকে নামিয়ে দিলেই হবে এখানে।”

এক রোড আগেই নেমে গিয়েছে শরীফ। সিগারেট কিনে ঢুকবে বাসায়। গলির মাথা থেকে ১৭০ সেকেন্ড সময় লাগে বাসার দরজায় আসতে। ভাবতে ভাবতে আজ বোধহয় একটু বেশি সময়ই লেগে গেল। আর বেল বাজানোর আগে খেয়াল করলো না যে দরজার উপরের ওয়েলকাম লাইটটা বন্ধ।
দুবার, তিনবার বেল বাজাল শরীফ। শান্তার কোন খোঁজ নেই। ফোন দেওয়ার জন্য হাতে মোবাইল নিয়ে দেখল ফোনের ব্যাটারি এম্পটি। চালুই হচ্ছে না। জোরে জোরে দরজায় থাবা দিল শরীফ। কোন জবাব নেই।
এত রাতে বাইরে গেল নাকি শান্তা? গেলে কোথায় যাবে? নাকি আমার দেরি দেখে ঘুমিয়ে পড়ল? অটো লকের জন্য তো বোঝারও উপায় নেই যে ভেতর থেকে লক করা না বাইরে থেকে। আচ্ছা শব্দের আওয়াজে ওর না হোক, বাবুর তো ঘুম ভাঙবে। তারমানে কী, বাবুও নেই? গাড়িও তো পার্ক করা বাইরে। তাহলে…

হুট করে বসের বলা একটা কথা মনে পড়ে গেল।

“কোন ঘটনাই কারণ ছাড়া ঘটে না।”

গলা ফাটিয়ে চিৎকার শুরু করল শরীফ, “শান্তা! শান্তা!”

পর্ব ৩ — প্রেমাতাল

দরজার ওপর এলিয়ে পড়ল একটা দীর্ঘ ছায়া। শরীফের এমনিতেই লম্বা শরীরটা আরও লম্বা হয়ে ছায়া আকারে হেলে পড়েছে কোন একটা আলো এসে পড়াতে।

আলোর উৎস খুঁজতে ঘুরে তাকালো শরীফ।

গাড়ির হেডলাইটটা চোখে লাগায় একটু সামনে আগালো সে। এই গাড়ি সে চেনে না। কে এসেছে? কেন এসেছে? নিজের অজান্তেই হোলস্টারে হাত চলে গেল শরীফের।

গাড়ি থেকে কোন প্রকার তাড়াহুড়ো ছাড়াই নেমে এল শান্তা, কোলে বাচ্চা।

“কোথায় ছিলে তুমি!”
“কোথায় ছিলাম মানে? তুমি টেক্সট পাওনি আমার? নাকি ফোন এখনও বন্ধ তোমার?”

কাজ করতে করতে কখন যে ফোনের চার্জ শেষ হয়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, সেটা শরীফ টেরও পায়নাই। আজ শপিং এর ডেট ছিল, তার খেয়াল নেই সেটাও। শান্তা অপেক্ষা করতে করতে শেষমেষ নিজেই চলে গেছে।

“গাড়ি নিলে না যে?”
“ব্রেক শু পাল্টানো লাগবে। রিস্ক নিই নাই এজন্যে।”
“ওহ আচ্ছা”, দরজা খুলতে খুলতে বলল শরীফ।
“তোমার এত দেরি কেন হল এটা জিজ্ঞাসা করে তো লাভ নাই, কিন্তু তুমি বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলে কেন ঘরে না ঢুকে, সেটা বলো”, শান্তা কিছুটা অবাক এবং বিরক্ত।
“ওহ না, আমি মাত্র ঢুকেছি। বস ড্রপ করেছে আমাকে আজকে।”
“কই, তোমার বসের গাড়ি তো দেখলাম না। ওহ ওয়েট!”
শরীফের পকেট হাতড়ে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করল শান্তা।
“এই মহাশয়কে খুঁজতে আগেই নেমে পড়েছ, তাইনা?”
বলেই শান্তা বাইরে ফেলে দিল প্যাকেটটা। শরীফ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আজ রাতে আর কাজ করা হবে না, ঘুমই ভরসা।

শেষ কবে এত প্রেমকাহিনী নিয়ে গবেষণা করেছে মনে পড়ছে না শরীফের। সাহিত্যিকদের বর্ণাঢ্য প্রেমজীবনের কথা টুকটাক জানা ছিল আগে থেকেই। বিশ্বখ্যাত বায়রন যেমন অগণিত প্রেম করেছেন তার ছোট্ট জীবনে, কিন্তু তার প্রথম প্রেমটা কিন্তু বিয়োগান্তক ছিল। বিশ্বাস করে বন্ধুকে বলেছিলেন তার ভাল লাগার কথা। ওই বন্ধু ভাল লাগার সংবাদ বাহক হতে গিয়ে নিজেই প্রাপিকার প্রেমে পড়ে গিয়ে প্রপোজ করে বসেন, এবং মেরি সেটা গ্রহণও করেন। এরপর থেকে নারীজাতির উপর বিতৃষ্ণা নিয়ে একের পর এক প্রেম করে গেছেন বায়রন, আর তার এই প্রেম উপাখ্যান তার অমর সাহিত্যের মতই বিখ্যাত (অনেকের কাছে কুখ্যাত)। শরীফের পড়ালেখা অবশ্য এখন বায়রনকে নিয়ে নয়, বাংলাদেশি মধ্যবয়স্ক এই সিঙ্গেল (!) লেখককে নিয়ে। তার মৃত্যুর পর টিকটকে একদিন ট্রেন্ডিং ছিল তার নাম। অনেক কিশোর কিশোরী কান্নাকাটি করে সেটার টিকটক বানিয়ে আপলোড করেছে। এত্ত এত্ত ভক্তের মধ্যে সন্দেহজনক কাউকে খুঁজে বের করা অসম্ভব। লেখকের ফোন আনলক করে সেখান থেকে কিছু উদ্ধার করে গিয়েছে, কিন্তু সমস্যা হয়েছে ডেটিং অ্যাপগুলো নিয়ে। ইমেইল আইডি থেকে হিস্টোরি ঘেঁটে দেখা গিয়েছে যে একাধিক ডেটিং অ্যাপ এ ওই আইডি থেকে একাউন্ট খোলা হয়েছে। কিন্তু ওসব অ্যাপের অনেক কনভার্সেশনই এখন আর নাই, ডীলিট করা হয়ে গেছে বলে ধারণা শরীফের। যেগুলো রয়ে গেছে, সেগুলো পড়তে পড়তে এমন একটা অবস্থা যে ওইসব কনভার্সেশন থেকে অলরেডি শান্তাকে ডায়লগ মেরে দিয়েছে দু একটা বাসায় গিয়ে গত কদিনে। অধিকাংশ মেয়েই শব্দ প্রশংসা শুনতে পছন্দ করে। শান্তাও ব্যতিক্রম নয়।

এক সপ্তাহ পর শপিং মলে বসের সাথে দেখা। শুরুর দিকে যেভাবে মাইক্রোম্যানেজের টেনডেন্সি দেখিয়েছিলেন সেটা অনেকটাই স্তিমিত হয়ে গেছে অলরেডি। গত এক সপ্তাহ তেমন একটা কথাবার্তা বলেন নাই কেস নিয়ে ওর সাথে। অবশ্য গত কদিন খালি মৃত লেখকের প্রেমজীবন নিয়েই ব্যস্ত ছিল শরীফ। ধন সম্পত্তি, জমিজমা, ব্যক্তিগত বিবাদ- ওর জুনিওর সিনিয়র কলিগরা একেকজন একেক মোটিভের সম্ভাবনার কথা বললেও, কেন যেন শরীফের মনে হচ্ছিল- রহস্য প্রেমেই লুকানো।

শপিং মলের ফুড কোর্ট গুলো আজও ঠিক আগের মতই ডিসকাউন্টেড কোয়ালিটির রয়ে গেছে। দুজনেরই বার্গার খেতে ইচ্ছে করায় বের হয়ে কাছেই একটা বার্গার জয়েন্টে যাবার সিদ্ধান্ত হল। বার্গার অর্ডার করে বসল দুজন।

“তারপর? প্রেমকাহিনী পড়া শেষ হলো তোমার?”
“ও কী আর সম্ভব, স্যার? লোক তো সেই প্লেয়ার ছিলেন, শব্দের যাদুকর!”
“হাহাহা! তুমিও মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেছ দেখছি।”
“না স্যার, আমি তো প্যাঁড়ায় আছি। জীবনে এই প্রথম কোন এক কেস পেলাম যার কোন কূলকিনারা পাচ্ছিনা।”
“আমার জীবনেও এরকম একবার হয়েছিল, বুঝলে?”
“বলেন কী স্যার! এরকম কেস?”
“নাহ। তবে এক্কেবারে ফাঁসানো কেস। কিচ্ছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না।”
“শেষমেষ সুরাহা করতে পেরেছিলেন?”
“কী কাহিনী হল, কীভাবে হল কিচ্ছু না জিগ্যেস করে একেবারে শেষ চ্যাপ্টারে চলে গেলে হে? এই তোমাদের নিয়ে হল বিপদ। খালি ডেস্টিনেশনে যেতে চাও, জার্নিতে ফোকাস কম তোমাদের। অথচ, আসল মজা এই জার্নিটাই।”
“পুরোটাই বলুন, স্যার।”
“নাহ, পুরোটা বলার আজ সময় নেই। তুমি উপসংহার জানতে চেয়েছিলে না? ফেঁসে যেবার গিয়েছিলাম বিয়েই করে ফেলেছিলাম, বুঝেছো? আর যাকে করেছি, তার একটা স্পেশাল অকেশান আছে, যার গিফটটা নিতে আমি ভুলে গেছি। আমি আমার বার্গারটা টেক এওয়ে নিচ্ছি, তোমারটা তুমি খেয়ে আস্তে ধীরে যাও, কেমন?”
“ওহ ওকে, শিওর স্যার।”
“ওহ হ্যাঁ, শরীফ। বলতে ভুলে গেছি। একদিন আসো বাসায়, ককটেল পার্টি হোক। তোমার ওয়াইফকেও নিয়ে আসলা, তাহলে আমি তুমি গল্প করতে পারব আমাদের মত করে, হাহা।”
“ওহ থ্যাংক ইউ, স্যার। কিন্তু শান্তা আবার এসব ককটেল , ওয়েল স্মোকিংও নিতে পারে না।”
“আরেহ ওসব বিষয় না। তাহলে ডীনার পার্টিই হবে, আর তুমি রিল্যাক্স করতে চাইলে নেক্সট ঠার্সডে নাইটে একাই চলে আসলা। উই ক্যান চিল।”
“ওকে, স্যার। ডান ডীল।”
“আচ্ছা, লাভার বয়ের গল্প তাহলে সেদিনই শুনব। গুডবাই।”

বার্গার খেয়ে আবার এক কফিশপে ঢুকে কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে দিল শরীফ। ট্রিপল শট এসপ্রেসো গিলেও মাথা কাজে দিচ্ছে না কোন। এমন একটা উদ্ভট লীড তাড়া করে ফিরছে যেটা নিয়ে জুনিয়র থেকে শুরু করে বস পর্যন্ত মজা নিচ্ছে। অথচ বাকি সব কটা লীড যে ডেড এন্ড, সেটাও শেষ কথা নয়। বাকি লীডগুলো পাত্তা দিলে শরীফের ভাবতে হবে যে খুনগুলো বিচ্ছিন্ন। কিন্তু সেটা মেনে নিতে পারছে না সে। শরীফের সেদিন বাসায় ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেল।
অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, শান্তা এখনও বাসায় ফিরে নি। গাড়ি নিয়ে গেছে অবশ্য আজকে। ফোন দিল, ফোন ধরল না শান্তা। আজ তো কোথায়ও যাওয়ারও কথা না। টিভি চালিয়ে বসল সে। এমন সময় শান্তা এসে ঘুকল বাসায়।
“গিয়েছিলে কোথায়?” স্ট্রেস দৃশ্যমান শরীফের গলায়।
“এটা কেমন প্রশ্ন? জেরা করছো নাকি তুমি আমাকে?” বলল শান্তা।
“নাহ সে কী করার অধিকার আছে নাকি?”
“বাজে বকছো কেন? আবার ড্রিংক করেছো তুমি?”
“নাহ, করিনি। আর করলেও কী! তুমি কোথায় যাও, কী করো কিছু বলো নাকি আমাকে?”
“হোয়াট ননসেন্স! তুমি এক কেস নিয়ে আধপাগল হয়ে আছো আর মানুষের ধার করা লাভ লেটার আমাকে এসে শোনাও, আমার কী হচ্ছে না হচ্ছে জিগ্যেস করার সময় হয়না তোমার, আর এখন বলছো আমি কিছু বলি না?”
“তুমি-”

টিভির দিকে চোখ পড়তে থেমে গেল শরীফ। ঝুলে পড়ল যেন চোয়াল। দৌড়ে রিমোট হাতে নিয়ে সাউন্ড বাড়িয়ে দিল। ব্রেকিং নিউজ। শহরতলীতে বীভৎস খুন। ভিকটিমের গলা দিয়ে বেঢপ সাইজের একটা মোবাইল ফোন ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। চাওফোনের লেটেস্ট মডেল, বেশ দামী ফোন। সরকারি কর্মকর্তা বলেই হয়ত এফোর্ড করতে পেরেছিলেন। ফোনটা ওয়াটারপ্রুফ কিন্তু তারপরেও রক্ত ঢুকে গিয়েছে কিনা সেটা নিয়ে কথা বলছে সংবাদপাঠিকা। লাশের পাশে পাওয়া গিয়েছে একটা মিউজিক প্লেয়ার। তাতে কয়েক দশক আগের একটা জনপ্রিয় বাংলা গান। গানের নাম প্রেমাতাল। গায়ক তাহসান। সেসময়ের সেলিব্রেটি কাপল ছিল তাহসান মিথিলা। পরে অবশ্য ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় বিয়ের কবছর পরে। কিন্তু প্রেমাতাল তাদের প্রেমজীবনের সাক্ষী। রিমোটটা ডিস্টার্ব করছে ইদানীং, অটো চ্যানেল চেঞ্জ হয়ে যায়। দু তিনটা চ্যানেল অটো চেঞ্জ হয়ে একটা বাংলা গানের চ্যানেল চালু হল। টিভির সাউন্ড আগেই বাড়ানো ছিল তাই ঘর জুড়ে গমগম করে উঠল তাহসানের গলা।

এ যেন সহজ স্বীকারোক্তি, আমি যুগান্তরী নই।
এ যেন ভীষণ আক্ষেপ আমার, আমি দিগ্বিজয়ী নই।
শুধু একটাই আশা আমি বুকে জড়িয়ে-
রবো সারাটি জীবন তোমায় নিয়ে।
কোনো এক নিঃসঙ্গ রোদেলা রাতে দেখেছি
প্রিয়তমা তোমার চোখে মিষ্টি হাসি,
কোনো এক দুঃসহ জোছনা দিনে বাতি নিভে গেলে
কড়া নেড়েছি তোমার হাতের ঘরে,
কিছু অর্থহীন শব্দ বুনে ডেকেছি তোমায়-
প্রেম তুমি কোথায়?
বিন্দু আমি, তুমি আমায় ঘিরে,
বৃত্তের ভেতর শুধু তুমি আছো।
মাতাল আমি তোমার প্রেমে,
তাই অর্থহীন সবই যে প্রেম লাগে।

পর্ব 8 — অগ্নিকাব্য (শেষপর্ব)

আমি শরীফ। এই গল্পের নায়ক (নাকি খলনায়ক?)। অল্প বয়েসেই বেশ কয়েকটা ক্রিটিক্যাল কেস সল্ভ করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু এই কেসটাতে আমি একটু খাবি খেয়ে গেছি।

ব্যাপারটা যে সিরিয়াল কিলিং এটা আমি সন্দেহ আগেই করেছিলাম, কিন্তু নিশ্চিত হতে পেরেছি ৩য় খুনের পর। এটলিস্ট কিলিং প্যাটার্ন টা বুঝতে পারা গেছে, কিছু একটা গলা দিয়ে জোর করে ঢুকিয়ে দিয়ে যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু। মোটিভ? এখনও বুঝা যাচ্ছে না, কিন্তু গানগুলোর সাথেও কিছু একটা সম্পর্ক আছে। ৩য় খুনটা ইনভেস্টিগেট করার আগেই সেটার খবর ভাইরাল হয়ে গেছে। আজকাল মিডিয়া ভাল কম্পিটিশান করে পুলিশের সাথে। এখন সিরিয়াল কিলিং নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকে শুরু করে আরও অনেক কিছুই হচ্ছে। আমার অবস্থা আসলেই বেশ নাজুক। কেসের কোন কূলকিনারা না করতেই এটা এখন মিডিয়া টপিক হয়ে গেছে। আবার ওদিকে শান্তার কিছু একটা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে যার কিছুই আমি বুঝতে পারছি না। তবে এসব হতেই পারে বিবাহিত জীবনে, আগেও দেখেছি সুতরাং সেটা খুব একটা পাত্তা দিলাম না। কোন ট্রেস ছাড়া এভাবে তিন তিনটা খুন- খুব অভিজ্ঞ কেউ আছে এর পেছনে। কিন্তু আমি আজও বুঝতে পারছি না, পুরো ব্যাপারটার সাথে আমি কোথা থেকে জড়িত। নাকি, ব্যাপারটা কেবল কাকতালীয়? তবে হ্যাঁ, সত্যি কথা বলতে গেলে কী, আমি বুঝতেই পারিনাই যে কত বড় বিপদে আছি, বৃহস্পতিবার বিকেলের আগে।

বৃহস্পতিবার বিকেল।
আমি দাঁড়িয়ে আছি চতুর্থ ভিকটিমের ডেডবডির সামনে। বাতাসে রক্তের গন্ধের পাশাপাশি অন্য একটা গন্ধও আছে। জিনিসটা সুগন্ধ হতে পারত। কিন্তু খুনের বেশ কিছুদিন পরে ডেডবডী আবিষ্কার হওয়াতে গলা ভর্তি ফুলগুলো পচে বিশ্রী আরও একটা গন্ধ বের হচ্ছে। আমার অবশ্য মৃতদেহ বা হত্যার উপকরণ ফুলগুলো নিয়ে কোন ইন্টারেস্ট নেই। কারণ আমি জানি আমি অনেক খুঁজেও কোন আলামত বা ছাপ খুঁজে পাবো না। আরও একটা কারণ আছে অবশ্য। আমি এই ভিকটিমকে চিনি। এই নাম আমার অনেক পরিচিত। আজ থেকে এক দশক আগে এই নাম নিয়ে অনেক কথা হয়েছিল তনিমার সাথে। তনিমা আমার প্রাক্তন। অনেক বছর আগে যখন ওর সাথে প্রেম করি প্রথম প্রথম ওর এক্স এর গল্প বলত ও। খুব ভালোবাসত নাকি ছেলেটাকে। একদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে অন্য একটা মেয়েকে একগাদা ফুল দেয়ারত অবস্থায় হাতেনাতে ধরা খায় ছেলেটা। কী রঙের ফুল ছিল সেটাও মনে রেখেছিল তনিমা। লাল নীল সাদা। রক্ত আর বমি ভর্তি ফুলগুলো দেখেও বুঝে উঠতে সমস্যা হয়নি আমার- লাল নীল সাদা। কিছুটা কাকতালীয়? বস বলেছেন কারণ ছাড়া কোন কিছুই হয় না, আর কিছুটা কাকতালীয় বলে কিছু নেই। হয় পুরোটাই কাকতালীয়, নয় একেবারেই না!

এই সেরেছে! বসের বাসায় তো যাওয়ার কথা আজ। কিন্তু আজকের এই ডিসকভারির পর আসলে নিজেকে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না আমার। কোথায় তনিমা? কী করছে সে? কেমন আছে? এই খুনগুলোর পেছনে কী সে আছে? কিন্তু এ কী করে সম্ভব! ওর মত আদুরে আহ্লাদি মেয়ে কী করে এরকম নির্ভুল সিরিয়াল কিলিং করবে? নাকি… অন্য কেউ? অদ্ভুত একটা সম্ভাবনা মাথায় আসতেই ফেলে দিতে চাইলাম। শান্তার খারাপ কিছু করিনি আমি কোনদিন। কিন্তু গত কয়েকদিন অদ্ভুত আচরণ… ধুর! কীসব ভাবছি আমি!
আচ্ছা, আমি সম্ভবত ওভারথিঙ্ক করছি। ব্যাপারটা পুরোটাই কাকতালীয় হতে পারে। কত মানুষই খুন হয়, দুর্ভাগ্যক্রমে আজ হয়ত আমার এক্সের এক্স খুন হয়ে গিয়েছে আজ। আই হ্যাভ টু বি লজিক্যাল। মাথা ফ্রেশ করা দরকার। স্যারের ইনভাইটেশনে যাই, কালকে আবার গোড়া থেকে শুরু করব ইনভেস্টিগেশন, কোন বায়াসড অপিনিয়ন ছাড়া। ভুল যা করার করে ফেলেছি। চার চারটে মানুষ মরে গেছে আমি কিছুই করতে পারিনি, এখন শুধরাতে হবে নিজেকে।

বসের বাসার ইন্টেরিয়রের সাথে আমার বাসার ইন্টেরিয়রের আশ্চর্যজনক মিল। গ্লাস হাতে নিয়ে বসে আছি আমি। বস বোতল খুলে দিয়ে ভেতরে গিয়েছেন। বেশ কবছর আগেও বাংলাদেশে তুষারপাত হবে সেটা কল্পনায় সীমাবদ্ধ ছিল। অথচ গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর ঠেলায় এখন শীতকালে মাইনাসে চলে যায় তাপমাত্রা, আর ঘরে ঘরে শোভা পায় ফায়ারপ্লেস। একটা সময়ে এই ফায়ারপ্লেস জিনিসটা অনেক ফ্যান্টাসির উপাদান ছিল অনেকের কাছে। আজ সেটা নিত্য ব্যবহার্য এক জিনিস।

“গান ছেড়ে দিই, কেমন? হোম থিয়েটারের পেছনে ম্যালা টাকা খরচ করেছি”, বস এসে পাশে বসলেন কাউচ টেনে।
“শিওর স্যার, তবে একটা কথা বলি যদি কিছু মনে না করেন?” একটু ইতস্তত করে বলল শরীফ।
“প্লীজ, গো এহেড।”
“স্যার, আজ কি আমরা কেসটা নিয়ে কোন কথা না বলতে পারি? আমি কালকে থেকে আবার গোড়া থেকে শুরু করতে চাচ্ছি, কারণ আমি পার্সোনাল কিছু বায়াসের কারণে মনে হয় ভজকট করে ফেলেছি সব। তার ওপর আজকের ভিকটিম আবার আমার এক্সের এক্স।”
“ওয়েট ওয়েট, হোল্ড অন, কী বলছো?”
“জ্বি স্যার, আই এম শিওর।”
“দিস মাস্ট বি হার্ড অন ইউ, বুঝতে পারছি। আচ্ছা, তোমাকে তাহলে এটা নিয়ে কিছু না বলি আজকে, যদিও মাথায় অনেক কিছু কিলবিল করছে।”
“আমার এক্স কে নিয়ে আলাপ করা যায়, যদি আপনি তাই জানতে চান। এটা কেসের সাথে সম্পর্কিত না। আশা করছি আরকি। হাহাহা।”

মাথাটা একটু দুলে উঠল। আজ একটু বেশিই খাওয়া হচ্ছে, এজন্য বোধহয়, নাকি একটানা আগুনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে?

আবারও চুমুক দিয়ে বসকে বলা শুরু করলাম তনিমার কথা। অদ্ভুত একটা প্রেম ছিল সেটা। ওভারলি এটাচড রিলেশনশিপ। শেষটাও খুব অদ্ভুতভাবে হয়েছিল। পালিয়ে বিয়ে করার কথা ছিল আমাদের। সেদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল হুট করেই, আর আমি একটু বেশিই খেয়ে ফেলেছিলাম, আজকের মতোই। তাই যেখানে দেখা করার কথা সেখানে আর যাইনি। তনিমা বৃষ্টিতে একা একা দুঘণ্টা ভেজার পর আমার ইন্সটাগ্রাম স্টোরি দেখে বুঝতে পারে যে আমি মাতাল। মেয়েটা খুব জেদি ছিল। জানত আমার এই অকশনাল ড্রিঙ্কিং প্রব্লেম এর কথা, অনেকবার অনেক ভোগান্তিও নিয়েছে সে এর আগে। কিন্তু আমাকে স্বাভাবিক করার জন্য অনেক এফোর্ট দিয়েছিল সে এতদিন। আমি ভাল হয়েও যাচ্ছিলাম আস্তে আস্তে, কিন্তু ওদিন কী মনে করে নিজেই একা নিজের ব্যাচেলর পার্টি করতে গিয়ে…
একটা ওপেন এয়ার ওয়েডিং এর আয়োজন ছিল। কাছের কজন ছিল ওখানে। সবাইকেই দাঁড় করিয়ে রেখেছিলাম। কারো ফোনই ধরিনি সেদিন। পরে মাতলামির ঘোরে স্টোরিতে আপ দিয়ে দিয়েছিলাম বারের ছবি, দেখে কাউকে কিছু না বলে পার্কের ঠিক মাঝে দুঘণ্টা দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজেছিল। কারো বারণ শোনেনি। অনেক কষ্ট পেয়েছিল মনে হয়। আর আমিও আর পরে যোগাযোগ করার চেষ্টা করিনি। কেন যেন মনে হচ্ছিল আমি রেডি না এসব এর জন্যে। এরপর আর কোনদিন তনিমার সাথে দেখা বা কথা হয়নি আমার। শুধু আজকে আমার আগের প্রেমিকের ডেডবডি দেখলাম, এত বছর পর।

“গলা শুকিয়ে গিয়েছে দেখি তোমার, দাঁড়াও আরেকটা বোতল নিয়ে আসতে বলি, আর আমার ওয়াইফের সাথে তো তোমার পরিচয় হয় নি।” বস আমাকে বলে এরপর বউ কে ডাকলেন।
“এই, আসো না। আর গানটা ছেড়ে দিয়ে আসো। জয়েন আস।”

সনির লেটেস্ট হোম থিয়েটার। আর গানটার সঙ্গীতায়োজন অসাধারণ। তাই অদ্ভুত এক ভাল লাগা ছড়িয়ে পড়ল আংশিক পচা কিডনিটার পাশেই কোথাও, যেখানে অন্তর থাকে মানুষের।

হাঁটছি আমি নিষ্প্রাণ হয়ে কোনো অজানা গন্তব্যে,
আক্ষেপগুলো ফিরিয়ে নিলাম গোছানো ডায়রিতে।
বাস্তবতা মেনে নিয়েছি স্বপ্নের বিপরীতে-
স্বপ্নগুলো উঁকি দিয়ে যায় মনের বন্ধ জানালাতে-
আমি হেরে গেছি এই বাস্তবতার মঞ্চে,
যেখানে ছিল না কোনো অভিনেতার অভিপ্রায়-
আমি ভেসে গেছি এই বাস্তবতার স্রোতে-
পাবেনা আর কখনো কুড়িয়ে আমায়।

আর মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে গেল একটা শীতল স্রোত। আর্টরেক এর এই আন্ডাররেটেড গানটা তনিমার খুব প্রিয় ছিল। ঝগড়া হলেই খালি লুপে ছেড়ে শুনত। এমনো হয়েছে, আমি ড্রাইভ করছি, সে ব্লুটুথ কানেক্ট করে টানা এক ঘণ্টা বাজিয়েছে এই গান। আমার গাড়িতে আলাদা ঊফার লাগানো থাকায় বদ্ধ স্পেসে খুব ভাল লাগত শুনতে গানটা। আর আমার মধ্যে এক ধরনের অনুতাপ কাজ করত, যে কারণে মিটিয়ে ফেলতাম সবকিছু কিছুক্ষণ পরেই।

আমি ঘাড় ঘুরিয়ে বসের দিকে তাকালাম। কষ্ট হল কাজটা করতে, নেশা ধরেছে বোধহয়। কিন্তু উনি আমার পেছনে কারো দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, “এসো তনিমা।”

“দশ বছরে খুব একটা পাল্টায়নি তোমার চেহারা।” বললাম তনিমাকে।
“আর বস, আসলেই কারণ ছাড়া কন কিছুই হয়না। বুঝতে পারলাম অবশেষে। এত্ত ক্লিন মার্ডার, কোন আলামত ছাড়া করে আসা প্রফেশনাল কিলার ছাড়া আর একজনের পক্ষেই সম্ভব। প্রফেশনাল কিলার- হান্টার।” বসের দিক তাকিয়ে মাথা হালকা নামালাম।
“ আগের জন নাহয় তোমার প্রাক্তন ছিল, বাকিরা কি করেছে?” তনিমার দিকে তাকালাম আবার।

“উমম, লেটস সী। প্রথমজন ছিল বাচ্চাকালের ক্রাশ। প্রেম নিবেদন করেছিলাম। সবার সামনে পূর্ণতা গানটা গেয়ে। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেছিল আর চড় মেরেছিল। দ্বিতীয়জন তো মহা পল্টিবাজ ছিল। এক সাথে কত জনকে কবিতা লিখত জানতামই না! ৩য় জন ফোনে টেক্সট দিয়েই ব্রেকআপ করেছিল বিনা নোটিশে। আর চতুর্থজন আমার সামনেই ফুল দিয়ে আরেক মেয়েকে.. “

হাত তুলে থামিয়ে দিলাম তনিমাকে। একটানা কথা বলে যাওয়ার স্বভাবটা আজও রয়ে গেছে। হাতটা কেন দশ মণ ওজনের লাগছে সেটা বুঝতে পারছি না।

“কিন্তু তোমার কয়জন প্রাক্তন প্রেমিক ছিল এটা রিলেশনশিপে থাকা অবস্থায় আমাকে বলোনি তোহ! এখন অবশ্য জানি, চারজন। ” স্মিত হাসিতে বললাম বসের বউকে।

“ভুল বললে শরীফ। পাঁচ।”

পৃথিবীতে আমার শোনা শেষ শব্দ ওটাই ছিল।

***

পরিশিষ্ট:
রিমোটটা ঠিক করা হয়নি আর শরীফের ড্রয়িং রুমে্র টিভিটার। খালি বাসায় হুট করে অন হয়ে গেল টিভিটা। সংবাদ পাঠিকা খবর পড়ছেন- ইন্টেলিজেন্স অফিসার শরীফের ডেডবডি আবিষ্কার হয় তার বাসার বেডরুমে। পেটভর্তি পানি ছিল। পানি গিলিয়ে মারা হয়েছে তাকে। খুনী সন্দেহে তার স্ত্রী শান্তাকে এরেস্ট করে পুলিশ। ধারণা করা হচ্ছে আগের চারটে খুনের পেছনেও শান্তা আছেন, এমনকি শরীফ নিজেও থাকতে পারেন এমন মন্তব্য করছেন ইন্টারনেটবাসী। টিকটকে ট্রেন্ডিং আছে সিরিয়াল কিলার শান্তা শরীফ হ্যাশট্যাগ, অনেকে ভিডিও আপলোড করছেন, বিশেষজ্ঞরা আতংক প্রকাশ করেছেন যে এতে করে সিরিয়াল কিলিং এ অনেকে অনুপ্রেরণা পেতে পারেন… “

--

--

Minhaz Fahme
Minhaz Fahme

Written by Minhaz Fahme

Penning fictions, reviews, and memories | Author of “How to Make a Game”, Entrepreneur, Game Designer & Metaverse Enthusiast

No responses yet