The Scientist
“চেয়ারম্যান সাহেব! তোমাকে তো কিছু বলা যায় না, বললেই তো ফেসবুকে লিখে দাও সেটা তুমি! তোমার থেকে সাবধান থাকতে হবে।”
এপ্রিল ২, ২০২১
রাত ১২ টা বেজে ৩৫ মিনিট।
আমি লিখাটা বাংলায় লিখবো, নাকি ইংরেজিতে- সেই ডিলেমা অনেক কষ্টে ভাঙচুর করে শেষমেষ বাংলায় ফেরত এলাম। আমি আমার রুমের বারান্দায় বসে আছি। বাইরে একটা আধখানা চাঁদ আছে, কিন্তু সেটা দেখা যাচ্ছে না এখন এখান থেকে। বারান্দায় আমি ছাড়াও রয়েছে একটা চেয়ার, যেটার ওপরে আমি সারফেসটা রেখেছি। আমার বোনের বদান্যতায় ফুলের টব আছে কয়েকটা। বাতাসে আমার রূমের পর্দাটা উড়ছে। ক্ল্যাসি গোলাপি পর্দা। কেনার সময় ছবি তুলে এক্সকে দেখাইসিলাম ছবি তুলে পাঠিয়ে(তার নিজেরই এই ঘরের বউ হয়ে আসার কথা ছিল তার কয়মাস পরে আফটার অল), সেও পছন্দ করছিল। কয় মাস পরে সব নিজেই নষ্ট করে গেছে, বাসায় কখনও আসা হয়নাই, কিন্তু পর্দার চয়েসটা খারাপ ছিলনা আসলে। দমকা বাতাসে এই ভারী পর্দা উড়ছে। আমার বারান্দা থেকে আকাশের অনেকটুকু দেখা যায়, কিন্তু আমি কখনোই এরকম ল্যাপটপ নিয়ে এসে বসি না তার একটাই কারণ- অনেক মশা! আজকেও আছে পালে পালে, কিন্তু আজ কেন যেন আরও অনেক কিছুর মতই এটাও গায়ে লাগছে না।
আমি নিজে ফ্লোরে পা মেলে আয়েশ করে বসেছি। আমার রুমের বারান্দাটা মোটামুটি ভালোই বড়। আব্বু বাড়ির ডিজাইন করার সময় এরকম বিশালায়তন (!) বারান্দা রাখার সময় আম্মু ভুরু কুঁচকে বলেছিল কী করবা এত বড় বারান্দা দিয়ে? আব্বু উত্তর দিল, “আমার রিটায়ারমেন্টের পর বই পড়ব বসে বসে ফাহমির বারান্দায়।”
রিটায়ারমেন্টের পর গত ২/৩ বছরে আব্বু কখনও আমার বারান্দায় বই পড়তে আসে নাই। কিছু জিনিস বোধহয় শুধু মনে মনে আর মুখে মুখে বলার জন্যই, কখনও সে বাস্তব হয়না। যেমন মোত্তালিব স্যারের আমার বাসায় দাওয়াত খাওয়ার ব্যাপারটা। কিছুদিন আগেও আম্মু জিজ্ঞাসা করছিল, “তোমার স্যারকে কি শনিবার দাওয়াত দিবা, নাকি গরুর মাংসটা রেঁধে ফেলব কালকে?” এতবছর সাধনার পরেও স্যারকে বাসায় খাওয়ানো হলো না শেষমেষ। স্যার আমাদের সবাইকে স্তব্ধ করে না ফেরার দেশে চলে গেছেন ১২ ঘণ্টার ওপর হয়ে গেছে ইতোমধ্যে।
আমি স্যারকে বাসায় দাওয়াত করছি অনেক বছর হল। স্যারের আসতে আপত্তি কখনোই ছিল না কিন্তু আমার বাসা ঢাকার এমাথা আর স্যারের বাসা ওমাথায় হবার কারণে আসলে হয়ে ওঠে নাই এতদিন। গতবছর লকডাউনের মাঝে নিজেই একদিন ফোন করে বলেছিলেন, “এত তো ডাকো বাসায়, এখন একেবারে চলে আসতেসি। দেখবা কোনদিন হাজির হয়ে গেছি।” কোন এক ঈদেই মনে হয় শুভেচ্ছা বিনিময়ের মাঝে জানালেন যে ইউসেট এ ভিসি হিসেবে জয়েন করছেন, গোপন রেখেছিলেন খবরটা, তাই কাউকে বলতে মানা করলেন। আমি খুশিতে লাফ দিলাম। স্যারকে বাসার কাছে পেতে যাচ্ছি! পেয়েছিলাম, দেখাও করেছি দুবার গিয়ে, কিন্তু বাসায় দাওয়াতের তারিখটা ফিক্স করার আগেই…
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর আইইউটি দুটোরই সিএসই ডিপার্টমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মোত্তালিব স্যারের কাছে বাংলাদেশ পুরোটাই ঋণী। কোথায় নেই তার ছাত্র? কয়েক দশকের শিক্ষাজীবনে এত ছাত্রকে নামে চিনতেন, আর ইউনিক এক্সপেরিয়েন্স দিয়েছেন এরকম কাউকে দেখিনাই। এই ভদ্রলোক দুই দশক আগের ছাত্রকেও চিনতেন, মনে রাখতেন সে কী কী বাঁদরামি করেছিল সে তখন। আর ডিপার্টমেন্ট, পাশ করার বছর, ইউনিভার্সিটি নির্বিশেষে সবার প্রোফাইলে আজ মোত্তালিব স্যার। মজার ব্যাপার হল, অনেকেই তাকে নিয়ে ইউনিক সব ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা লিখে শেয়ার দিচ্ছে। এইযে এত্তগুলো ছাত্রকে ইউনিক অভিজ্ঞতা দেওয়া- আলাদা আলাদা নাম দেওয়া- কজন শিক্ষক পারেন এটা এত্ত বছর ধরে কনসিস্টেন্টলি করতে? এত্ত এত্ত হাসিমুখ, হাজার হাজার জীবনে আনন্দের অনুভূতি, আর তার দেওয়া অনুপ্রেরণা নিয়ে সারা বিশ্বজুড়ে সব ছাত্ররা- স্যারের মত কি আদৌ কি হতে পারবেন কেউ?
এপ্রিল ১, ২০২১
মাহফুজ আর তানভীরের (আইইউটি ১৩) সাথে দিনের শেষ সময়টা কাটালাম। আমি আহত হৃদয়ের আইইউটিয়ান হৃদয় এর সঙ্গ চাচ্ছিলাম আসলে। বসিলা বুদ্ধিজীবী কবরস্থান থেকে ফেরার পথে মাহফুজ ফোন দিল। গেলাম। স্যারকে নিয়া কোন কথা বলিনাই আমরা। বলা লাগেনাই। মাহফুজের সাথে কখনও গঠনমূলক আলোচনা করা লাগে না আমার। মনে মনে কথা বলে নিই আমরা পাশাপাশি থাকলে। মিস হয়না কোনদিন। মাহফুজ চাইছিল রাতে তানভীরের বাসায় আমাকে রেখে দিতে। মনে হয় ওর ধারণা হইসিল ফাহমি ভাই আজকে চিল্লায়ে কাঁদতে চাবে, কাঁদার একটা জায়গা দিই। আমি সারাদিনে এক ফোঁটা কাঁদিনাই। একা যখন গাড়িতে বসেছিলাম তখন প্রীতমের একটা গান ছেড়ে শুনেছি লুপে দিয়েঃ
“তুমি ভেঙে পড়োনা এইভাবে, কেউ থাকেনা চিরদিন সাথে।”
সারাদিন অবশ্য অনেক কাজ করেছি। ৩ টা মীটিং করেছি, সব আউটডোর। তার মাঝে শুধু স্যারের আত্মীয়দের কাছ থেকে জানাজার টাইম প্লেস জেনে নিয়ে অল আইইউটিয়ান্স এ দিয়েছিলাম। হোমপেজ স্ক্রল করতে গিয়ে কেন জানি বারবার দম আটকে আসছিল। বেশিক্ষণ করতে পারিনাই হোমপেজ স্ক্রল টানা কখনও। সালমান কালো প্রোফাইল পিকচার আর কভার দিয়ে রাখসে, স্যারকে অসম্ভব ভালোবাসত ছেলেটা। প্রাঙ্গণ কানাডাতে বসে স্যারের সাথে ব্যক্তিগত স্মৃতি নিয়ে পোস্ট করছে- এরকম আরও হাজারো স্টুডেন্ট। আইইউটি, ঢাবি, ব্র্যাক, ইউল্যাব, ইউসেট আরও অনেক ভার্সিটির ছেলেপেলে। আমার হোমপেজ জুড়ে কেবলই স্যার। এর মাঝখানে রাসিফ ভাই বিদেশ থেকে কান্নাভেজা গলায় ফোন দিয়ে বললেন পারলে ভিডিও করে পাঠাতে। রাসিফ ভাইকে স্যার খুব ভালবাসতেন, তার কথা প্রায়ই বলতেন আমার কাছে। আমি সকাল বেলা মাহফুজ এর ফোনেই জেনেছিলাম যে স্যার আর নাই। খবর জানার পর থেকে… পর থেকে… জানিনা আসলে। কিছুটা ব্লার লাগছে গোটা দিনটাই কেমন জানি। স্যার আইসিইউ তে ভর্তি হয়েছেন শুনে ঘুমাতে গিয়েছিলাম। সকালে উঠে রেডি হয়েই জানতে পেলাম যে স্যারের সাথে আর কোনদিন কোনদিন কথা হবে না। এও কী হয়? এটাও সম্ভব? এতিম এতিম লাগছে। ছোটবেলা থেকে শুরু করে জীবনে অনেক অসাধারণ শিক্ষকের পায়ের ধুলো পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। কিন্তু এত কাছের কি কেউ আছে? মন খারাপ থাকলে, মন ভাল থাকলে, শিক্ষক হিসেবে, কোম্পানির এডভাইজার হিসেবে, প্রিয় মানুষ হিসেবে এত্তগুলো বছর ধরে? কী হারালাম আজ আমি?
মার্চ ২৫, ২০২১
স্যারের শরীরের খোঁজ নিতে খবর ফোন দিয়েছিলাম। স্যার বললেন তার ভাই এর সাথে দেশের বাড়ি গিয়েছিলেন। তারা দুজনেই কোভিড পজেটিভ ছিলেন। তিনি তার বড় ভাই কে নিয়েই টেনশনে ছিলেন কারণ তার কিছু কমপ্লিকেশনান্স ছিল। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আইসিইউ কোথায় ভাল হবে। আমি বলে রাখলাম স্যার কখন কী লাগবে বইলেন। সাহস দিলাম। বললাম, স্যার আপনি অনেক স্ট্রং। মেজারমেন্টস নিয়ে রাখেন, আল্লাহ ভরসা, ঠিক হয়ে যাবে সব। স্যার বললেন, “আরে তোমরা যতই বলো, বয়স তো কিছুটা হইসে! এখন আর আগের মত নাই!”
আমি ভাবতেও পারিনাই, সারাজীবন এত কথা বলা স্যার আমার আর কোনদিন কিছু বলবেন না আমাকে এরপরে!
মিড মার্চ, ২০২১
স্যার কবে বাসায় আসবেন দাওয়াতে, সেটা ঠিক করতে ফোন দিয়েছিলাম। ওমা, স্যার বললেন স্যার নাকি কোভিড পজেটিভ। স্যার বললেন, “সেদিন যার কথা বলেছিলাম কোভিড পজেটিভ তার থেকেই হল কিনা, কে জানে!” আমি সাহস দিয়ে খোঁজখবর নিলাম। বললাম, “তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যান, তারপর আসবেন বাসায় ইনশাল্লাহ।”
মার্চ ৯, ২০২১
স্যারের ইউসেট এর ভিসি হয়ে এসেছিলেন, যেটা আমার বাসা থেকে ১০ মিনিটের হাঁটাপথ। এলাকাভিত্তিক কিছু ব্যাপারস্যাপার আর ওভারঅল মার্কেটিং এ আলোচনার জন্য স্যার যেতে বলেছিলেন। আমি আমার বন্ধু রাশিককে নিয়ে গেলাম। নারায়নগঞ্জে ওদের হোল্ড অসাধারণ। রাশিক বুয়েটিয়ান, কিন্তু স্যার তার চিরাচরিত স্বভাবমত ওকে আপন করে নিলেন। স্যার ফেস শিল্ড, ডাবল মাস্ক- সবকিছু পরে অফিস করতেন। নতুন প্রতিষ্ঠান, কিন্তু স্যার নখদর্পণে নিয়ে এসেছেন সবকিছু অল্প সময়ের মধ্যেই। কথার মাঝে হুট করে একজন এসে জানালো গতকাল গায়ে জ্বর ছিল এমন এক ব্যক্তি আজ আবার অফিসে এসেছেন। স্যার সাথেসাথেই রিএক্ট করলেন আর বাসায় পাঠিয়ে দিতে বললেন। পরবর্তীতে জানা যায় ওই ব্যক্তির কোভিড পজেটিভ। স্যার সাথেসাথে সব কার্যক্রম হোম অফিসে নিয়ে যান। কেন যেন সেদিনের কোন ছবি আমার ফোনে তোলা হয়নি। এখানেও একটা আক্ষেপ জমা রয়ে গেল।
ফেব্রুয়ারি ৯, ২০২১
স্যারকে দাওয়াত খাওয়াতে গিয়ে আবারও তার দাওয়াত খেতে হল! স্যার ইউসেট এর ভিসি হয়ে এসেছেন গত সপ্তাহে। অফিসিয়ালি দেখা করতে যাওয়ার কথা- গেলাম। আমাকে পেয়ে মহাখুশি হয়ে গেলেন! পুরো ২৭০০০ স্কোয়ার ফিটের ক্যাম্পাস নিজেই আমাকে ট্যুর দেওয়ালেন হেঁটে হেঁটে। আমার বাসা পাশে, কিন্তু উলটো আমাকেই দুপুরের খাবার খাইয়ে তারপর বাসায় পাঠালেন। আমি বলেছিলাম — পরবর্তী দেখায় আপনাকে বাসায় ধরে নিয়ে যাব!
ব্যাটারী লোর ৭ম বর্ষে পদার্পণ উপলক্ষে শুভেচ্ছাবার্তার ভিডিও এক টেকেই হয়ে গেল। ৬৫ বয়সের মানুষটা তারুণ্যের মত উচ্ছলতায় দুই হাত তুলে সাত আঙুল দেখিয়ে দিলখোলা হাসিতে বলে উঠলেন, “ইটস দ্য সেভেন্থ ইয়ার, ওকে?!”
“বুঝলে, আমি তো আগে ডাকাত ছিলাম, ভার্সিটি লাইফে”- বলে কীভাবে ক্যাম্পাসের ত্রাস ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, আর ৭১ এ কীভাবে হানাদার হান্ট করেছেন সে গল্প আবারও করলেন। আমি এই গল্প আরও ১০০ বার শুনতে পারতাম তার কাছে, একটুও পুরনো হত না। স্যার একজন অসামান্য স্টোরিটেলার। আমি ভাগ্যবান, আলহামদুলিল্লাহ বেশ অনেকদিন স্যারের সান্নিধ্য পেয়েছি। আফসোস, আর গল্প শোনা হবে না আমার।
জানুয়ারি ৬, ২০২০
ইউল্যাবের সি এস ই ডিপার্টমেন্টের হেড তখন স্যার। একদিন ইউল্যাব এ গিয়েছি এরকম আড্ডা দিতে (আমি প্রায়ই যেতাম স্যারের অফিসে, নিয়মিত বিরতিতে, এমনিতেই!)। গিয়ে দেখি ওখানেও স্যার এক আইইউটিয়ান এর রিকমেন্ডেশন লেটার দিচ্ছেন। বললেন, “তোমরা আইইউটিয়ানরা আমাকে ছাড়লে না, বুঝলে? হিসাবে কিন্তু তোমাদের দূরে ঠেলা উচিত, অনেক হয়েছে আইইউটি এ জীবনে। কিন্তু কেবল কাছেই চলে আসো। যেখানেই যাই, কেমন করে যেন চলে আসো খালি আমার কাছে। আইইউটির পরে দুইটা প্রতিষ্ঠান পার করে ফেললাম , তাও তোমরা ছাড়লে না।” আমি বললাম, “আপনাকে ছাড়া অসম্ভব, স্যার, এটা আজীবন থাকবে।”
স্যার আসার সময় বললেন এখান থেকে কই যাবা? আমি বললাম — গুলশানে সিএসই ১২ এর মীটআপ আছে। স্যার বললেন, “ওহ! আইইউটির সব দুষ্ট ছানাপোনা! আচ্ছা চলো, তোমাকে আগায়ে দিয়ে আসি।” এই লোক সেই বেড়ীবাঁধ থেকে বাসা থেকে অন্য পথে গুলশান আসলেন কেবল আমাকে নামায়ে দিয়ে বাকিদের একনজর দেখতে। সবাই তো অবাক আর ভয়ানক খুশি স্যারকে দেখে!
আগস্ট ৩১, ২০১৯
স্যারের ছেলে নিলয় ব্যাটারী লো তে ইন্টার্নশিপ করছিল। তো ওর যেদিন ফেয়ারওয়েল, সেদিন আইইউটির একটা ছেলেরও ফেয়ারওয়েল- দেওয়ান ফাহিম। ছেলের ফেয়ারওয়েল উপলক্ষে ম্যাডামকেও নিয়ে আসলেন স্যার নিজে সশরীরে উপস্থিত হয়ে, আর প্রোগ্রামের কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে দিলেন দুই বিদায়ী ইন্টার্ণকে।
ভার্সিটির কোন হেডস্যার এতটা ফ্রেন্ডলি আর এনার্জেটিক হয়? ব্যাটারী লোর বাকি সুপারহিরোদের সাথেও স্যার আলাদাভাবে একজন একজন করে পরিচিত হয়েছিলেন। ম্যাডাম আমাকে একটা ফ্লাওয়ার ভাস গিফট করেছিলেন পরবর্তীতে, স্যার সেটা এসে আবার দিয়েও গিয়েছিলেন। আমার ড্রয়িং রুমে বসে আছে সেটা এখন, তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
জানুয়ারি ২৭, ২০১৯
আমরা ভাগ্যবান, স্যার ব্যাটারি লোর এডভাইজার এবং অভিভাবক ছিলেন। ব্র্যাকে প্রায়ই যেতাম নিয়মিত বিরতিতে স্যারের সাথে কথা বলতে। ৫ম বর্ষে পদার্পণ উপলক্ষে স্যারের ভিডিও নিয়ে গেলাম। স্যার জিজ্ঞেস করলেন, “এই তুমি যেন কী কোম্পানির?” “চেয়ারম্যান, স্যার।” “বাহ বাহ বাহ! আর ইশতিয়াক?” “ম্যানেজিং ডিরেক্টর, স্যার” “এই সারছে! সব বড় বড় পদ নিজেরা নিয়ে বসে আছো, হেহ? এই আমাকে একটা পদ দাও, দেবা না? স্যারকে চাকরি দিবা? তারপর বলো কী করছো। ওই জার্মানির কাজটা ভাল করে করো, বুঝলা।” দেখা হলেই জিজ্ঞেস করতেন বিভিন্ন ছাত্রের কথা। “সাব্বিরটা দেশে আসছে? বড্ড দুষ্ট ছিল ছেলেটা! তোমার ভুঁড়িওয়ালা বন্ধুর কী খবর?”
অক্টোবর ২৩, ২০১৮
ব্র্যাকে স্যার একটা ট্রেনিং প্রোগ্রাম নিতে বলেছিলেন অগমেন্টেড আর ভার্চুয়াল রিয়েলিটি নিয়ে। ইশতিয়াক ভাই, রাফি আর আমার সেশন ছিল। ওইটার ক্লোজিং উপলক্ষে ডেকেছিলেন আমাদের।
ব্র্যাকে সি এস ই র হেডস্যার থাকা অবস্থায় সবার প্রিয়পাত্র ছিলেন স্যার, ঠিক আইইউটিতে যেমন ছিলেন। রাত ৯/১০ টা পর্যন্তও অফিস করতেন। ২০১৯ সালে যেদিন স্যারের শেষ কর্মদিবস ছিল ব্র্যাকে, সেদিনও থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। রুম ভরে গিয়েছিল ফ্যাকাল্টি দিয়ে। আইইউটিয়ান, নন আইউটিয়ান নির্বিশেষে। জায়গা না হওয়ায় রুমের দরজা খুলে করিডোরেও দাঁড়িয়েছিলেন কয়েকজন। সেশন শেষে জাস্ট দেখা করতে এসেছিলাম আমি, ফয়সাল, সালমান এরা, দেখাদেখি সবাই চলে আসল। অনেকে গিফট নিয়ে আসছেন। কোন ফেয়ারওয়েল কিন্তু না, জাস্ট এমনিতেই! চোখে পানিও দেখলাম দু একজনের।
মে ১৫, ২০১৮
তখন নিকেতন অফিস আমাদের। স্যারকে আনার চেষ্টা করছি অনেকদিন হল। শেষমেষ কায়দা করে স্যারের জন্মদিনেই অফিস ভিজিটের ডেট ফেললাম। সেদিন আবার আমাদের হাল্ক সাহেব রাফিরও জন্মদিন। তো, দুইটা কেক আনলাম আমরা। স্যার বললেন, যদিও এটা সার্টিফিকেটের জন্মদিন, কিন্তু যেহেতু পালন করতে চাচ্ছো, আসো করি! আমার সানগ্লাসটা চেয়ে নিয়ে সেটা নিয়ে পড়লেন, আর রাফিকে ডাকলেন “বার্থডে বাডি”।
মার্চ ৩১, ২০১৮
রাজউকের একটা ফেস্টে টেক পার্টনার হয়ে ব্যাটারি লো গিয়েছিল। স্যার ছিলেন চিফ গেস্ট ওই ফেস্টের। আমাদের কথা শুনে উপরে এলেন আমাদের আউটরীচ প্রোগ্রাম দেখতে। স্যারকে দিলাম প্রথমবারের মত ভার্চুয়াল রিয়েলিটির এক্সপেরিয়েন্স, উনিও বেশ মজা পেলেন। কিছুদিন আগেই স্যারের সাথে দেখা হয়েছিল, তার বাসায় গিয়েছিলাম। ততদিনে “Forever our Head Sir” নামেই আইইউটিয়ানরা ডাকত উনাকে।
মার্চ ৮, ২০১৮
স্যার বাসায় নিয়ে গেলেন আমাকে। চায়নিজ কিনে নিয়ে পার্সেল নিলেন কারণ বাসায় কেউ ছিল না। বাসায় নিয়ে যত্ন করে খাওয়ালেন আমাকে। খুব আগ্রহ নিয়ে ছবি তুললাম আমরা দুজন।
“বুঝলে, তোমাদের তো বকা দিছি, এখন তোমরাও তো বকা দিবে। খালি ছোটরাই পছন্দ করে আরকি। তো, ভাল আছে তো তোমাদের আইইউটি?”
মে ১৩, ২০১৭
আমি আইইউটির সাতে পাঁচে নাই বেশ কিছুটা সময় ধরে, সঙ্গত কারণেই। কিন্তু মে এর ১১/১২ তারিখেই সম্ভবত ফেসবুকে আবরার ফাইয়াজ সহ কয়েকজন ফ্যাকাল্টির পোস্ট দেখলাম যে স্যারের সাথে অভাবনীয় একটা কাজ করা হয়েছে। যেই লোক আইইউটির সিএসই ডিপার্টমেন্টের গোড়াপত্তন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত আনলেন, যার জন্য দেশে বিদেশে এত্ত আইইউটিয়ান উদ্যোক্তা, প্রোগ্রামার, এবং অন্যান্য ডোমেইনের রকস্টার, ১৭ বছরেরও বেশি সময় ধরে যাকে নিজের বাচ্চার মত করে বড় করলেন তাকে একটা সুন্দর প্রস্থান পর্যন্ত আইইউটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে দিতে পারে নাই। আমি প্যারা খেয়ে গেলাম সবকিছু দেখে আর স্যারকে ফোন দিয়ে বললাম স্যার, কালকে বাসায় আসতেসি। ছুটে গেলাম। স্যারকে এরকম অবস্থায় আগে কখনও দেখিনাই। কেমন যেন অবিশ্বাস তার মধ্যে। “বুঝলে, আমার জীবনের সবচেয়ে বেশি সময় আমি আইইউটিতে দিয়েছি। ১৭ বছরের বেশি সময় দিনে ১০/১২ ঘণ্টা করে। আমার বাসায়ও কি এত সময় আমি দিয়েছি, বলো? না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়?” আমি উত্তর দিতে পারলাম না। আমরা পাশ করে বের হবার কমাস পরেই এ ঘটনা! স্যার আসার সময় বললেন, “চেয়ারম্যান সাহেব! তোমরা চাকরি টাকরি দিও স্যারকে, আমি তো বেকার এখন!” আমি বললাম, “কোম্পানি তো আপনারই বাচ্চা, স্যার। আমরা যেমন আপনার ছানাপোনা!”
ডিসেম্বর ৭, ২০১৬
গ্র্যাজুয়েশন ডিনারে হেডস্যার নিজে সবাইকে আপ্যায়ন করে খাওয়ান, এটা আগেই শুনেছিলাম। সেদিন দেখলাম। গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রামের আগে অডিটরিয়ামের বাইরে স্যারের সাথে দেখা। তুলে ফেললাম এই ছবি। স্যার কাছে টেনে নিলেন।
নভেম্বর ২৯, ২০১৬
রেড ফ্রাইডে।
ভর্তি দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে আন্দোলনে উত্তাল সেদিন আইইউটি। তৎকালীন ভিসির অফিসের নিচে অবস্থান নিয়েছি আমরা। ৫টা পর্যন্ত আল্টিমেটাম দেওয়া। এরমধ্যে ৪ দফা দাবি না মানলে আমরা কনভোকেশন বয়কট করবো বলে ঘোষণা দিয়েছি। আমাদের আইইউটি ব্যাচ বারোর নেতৃত্বে বর্তমান ও এক্স আইইউটিয়ান সবাই অংশ নিয়েছেন আন্দোলনে। স্লোগানে স্লোগানে কাঁপাকাঁপি অবস্থা। ভিসি নিজে আমাদেরকে ফেস করার সাহস নাই। তাই তিনি চার ডিপার্টমেন্ট হেডকে পাঠালেন আমাদের সাথে সমঝোতা করলেন। স্যাররা সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছেন। আমরা স্লোগান দিচ্ছি, উনারা দেখছেন। মোত্তালিব স্যারের মুখে কি কি মিটিমিটি হাসি দেখলাম? নাকি ভুল দেখছি? একটু পর স্যার আমাদের দিকে তাকিয়ে হাত নিচ থেকে উপরের উঠালেন নামালেন। মানে উনি উৎসাহ দিচ্ছেন! আমরা সবাই তো একেবারে পাগল হয়ে গেলাম একেবারে! একটু পর সাইডে আমি, উসামা, রাজি, ওয়াসেল আরও অনেকে ছিলাম আমাদের ডেকে স্যার বললেন,
“ শুনো- তোমরা গেট টেট সব দিছো তো ঠিকমত? সবদিক ঘেরাও করেছো? পালাতে পারবে না তো?”
আহ আইইউটি ১২! আহ হেডস্যার!
অক্টোবর, ২০১৫
তৃতীয় বর্ষে থাকাবস্থায় আইসিটি ফেস্টে আইটি বিজনেস আইডিয়া কম্পিটিশান আয়োজনের দায়িত্ব আমার ঘাড়ে। স্যার আসলেন রেজাল্ট ঘোষণা করতে আর বিচারকদের বিদায় দিতে। রিজভী ভাই আর শিবলী ভাই এসেছিলেন। অনেক সিনিয়র ব্যাচ তারা, কিন্তু স্যারের সাথে সখ্যতা ঠিক আগের মতই। যাবার সময় উসামাকে ডেকে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “এই, বলো তো কার ভুঁড়ি বেশি? উসামারটা, না আমার?” বলে গুঁতো দিলেন উসামার ভুঁড়িতে একটা!
মে/ জুন, ২০১৫
ব্যাটারী লো ফর্ম করার একমাসের মাথায় আমাদের বানানো ৩য় গেমটা নিয়ে মাইক্রোসফট ইমাজিন কাপে পার্টিসিপেট করি আমরা। সেটা জেতার পর স্যারকে জানাতে গেলাম সংবাদ। স্যার শুনেই লাফ দিইয়ে উঠলেন ডেস্ক থেকে! ডীপার্টমেন্টের হনারারি বোর্ড রাখার জায়গায় গিয়ে শহীদ ভাইকে ডেকে বললেন,
“এই, নতুন বোর্ড বানায়ে দাও, এই বোর্ডে তো জায়গা হবে না আর! ছাত্ররা এত্তকিছু জিততেসে!”
আমি ইশতিয়াক ভাই সহ বাকি সব ফাউন্ডাররা মিলে ভাবলাম, স্যার স্বয়ং এত্ত খুশি! মনে হয় আসলেও ছোটখাটো কিছু একটা করে ফেলেছি! ব্যাটারী লো নিয়ে কন্টিনিউ করার একটা বড় প্রেরণা ছিল স্যারের সেদিনের এই লম্ফঝম্প! এর আগেও যখনি আইইউটির হয়ে বিসনেস কেস কম্পিটিশান জিতেছি, বা মার্স রোভার বানিয়ে ইউরোপে কনটেস্ট করেছি, স্যার অনেক বেশি খুশি হয়েছেন। ছাত্রদের অর্জন লোকটাকে আনন্দিত করত সবচেয়ে বেশি! শুধু নিজের ডিপার্টমেন্ট না, সব ডিপার্টমেন্টের ছাত্রদের অনুপ্রেরণা ছিলেন স্যার!
ডিসেম্বর, ২০১২
আইইউটিতে প্রথম সপ্তাহ। কিচ্ছুই বুঝতেসি না, সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। পরিচিতিপর্বে গিয়ে উলটো আরও অপরিচিত হয়ে যাচ্ছি। এরপমধ্যে রুটিন দিল। রুটিনে একটা কোর্সের ফ্যাকাল্টির নাম লেখা “MAM”। আমি এক বড় ভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম ম্যাম মানে কী। আর এক দফা পরিচিতিপর্ব শেষে জানতে পারলাম ডিপার্টমেন্টের হেডস্যার ক্লাস নিবেন। ক্লাসের একটাই হ্যাক- সবসময় প্রেজেন্ট থাকতে হবে আর ক্লাসে ঘুমানো যাবে না। পরে জেনেছিলাম যে স্যার কম্পিউটার ফান্ডামেন্টালস নিতে চান ফার্স্ট সেমিস্টারে যাতে তখনই সবার সাথে পরিচিত হতে পারেন। এরকম একজন একজন করে প্রত্যেকটা ছাত্রকে চেনার চেষ্টা- এত্ত এফোর্ট!
পরিশিষ্ট
হাজার হাজার ছাত্রের আক্ষেপ, কারো শেষ কথা না হবার, কারো দেখা না হবার, কারো কোন গল্প না বলার/ শোনার, কারো বাসায় দাওয়াত না খাওয়ানোর, মুখ ফুটে না বলা হয়ে ওঠা যে কত্ত গর্বিত এমন একজনকে শিক্ষক হিসেবে পেয়ে, কিংবা একটা শেষ…
কোল্ডপ্লের দ্য সায়েন্টিস্ট লুপে দিয়ে রাখছি। গানটার মিউজিক ভিডিওটা অদ্ভুত- পুরোটা রিভার্সে প্লে হয়। আমার এই লিখাটা শেষ থেকে প্যারাগ্রাফ ধরে উল্টো অর্ডারে পুরোটা পড়ে দেখতে পারেন সময় থাকলে। আমার আজ রাতে অনেক সময়। আমি নিজেই এক্সপেরিমেন্ট করলাম নিজের জন্য। ছোটবেলায় শিখেছিলাম সবচেয়ে ব্রিলিয়ান্ট মানুষ হলেন বিজ্ঞানীরা। আমার কল্পনার চোখে ব্যাটম্যান মানেই ক্রিশ্চিয়ান বেল, বিজ্ঞানী বলতে লম্বা সাদা চুলের ভুঁড়িওয়ালা এক ভদ্রলোক, কম্পিউটার সায়েন্সে বাংলাদেশের প্রথম ডক্টরেট- বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রফেসর ডঃ আব্দুল মোত্তালিব।
-
The Orphan
(Your “Chairman Shaheb”)