সমদ্বিবাহু ত্রিভুজ
১
ছোটবেলায় বাবা মা বলত নেশা কখনও একবারের জন্যে হলেও টেস্ট করা যাবে না। কারণ যে একবার করবে, সে কোন না কোনবার আবার করবেই। নিউমার্কেট হচ্ছে ওইরকম একটা নেশা। এখানে শপিং এর একটা অন্যরকম গন্ধ আছে। যখন ক্রয়ক্ষমতা সীমিত ছিল, ঠিক মধ্যবিত্তদের মত তখন অভ্যেস ছিল নিউমার্কেট। আজ পিংক সিটি আর পুলিশ প্লাজা ছাড়া কোথাও যাওয়া মোটামুটি অপ্রয়োজনীয়। বড়জোর বসুন্ধরা সিটি পর্যন্ত। তাও মেইনলি সিনেপ্লেক্সের জন্য। কিন্তু ল্যাব এইডের ওপাশে ধানমণ্ডি ছাড়া আর কোন কিছু যে আছে সেটা ভুলেই গেছি বেশ অনেকদিন হল। কিন্তু আজ নিউমার্কেট যাওয়া হবে। তেমন কিছু না, একটা ব্যাগ কিনতে যাব। উদ্ভট শখ হয় মাঝেমধ্যে আমার। এর কোন ব্যাখ্যা নেই। আমার ঠাণ্ডার সমস্যা আছে, টিপ টিপ বৃষ্টি আমার একদমই পছন্দ না। কিন্তু কথা নেই বার্তা নেই হুট করে দেখা যাবে ঝুম বৃষ্টিতে ভিজতে চলে গেছি ছাদে একদম। কারণ ঠাণ্ডার সাথে পরিচয় হবার আগ থেকে আমি বৃষ্টিকে চিনি। আমি জানি ওর গন্ধ, মাদকতা, উন্মাদনা। বুকের ভেতরে তাই সবসময়েই একটা টান কাজ করে, কিন্তু সামনে আনতে দিই না সচরাচর। কিছু ভালোবাসা গোপন থাকাই ভাল। কাউকে বলতে হয় না। দূর থেকে সময়মত সবাই দেখে, আর অবাক হয়। হিসেব মেলে না তাদের। ভালোবাসায় কোন হিসেব নেই- এই জিনিসটা তারা জানে না। হয়ত স্কুল কলেজে ভালোবাসার ব্যাকরণ শেখানো হয়নাই, তাই বোধহয়।
এই দেখো, বৃষ্টির কথা বলতে বলতে বৃষ্টি ফোন দিয়ে দিল। দেরি করে ফেলেছি আজও। ভাবনায় হারিয়ে গেলে আমার দেরি হয়ে যায় রেডি হতে। কিন্তু বৃষ্টি কোনদিন দেরি করে না। মেয়েটার এই একটা অদ্ভুত বিষয়। আমি নিজে মেয়ে হয়েও কখনও ওরে কখনোই বুঝতে পারিনাই। কী কী যে করে, কীভাবে করে কে জানে! আমার জীবনটা এতগুলো এক্টিভিটিতে ভর্তি। কর্পোরেট জব করি, তার পাশাপাশি শখের গান। টিভি শো থাকে প্রতি সপ্তাহেই। এতকিছু সামলেও সময় মেনে চলা হয় না, অথচ মাস্টার্সে পড়া এই মেয়েটা কোনদিন একটা মিনিট দেরি করে নাই। হেডফোনটা কানে ঢুকালাম আমি।
“এইযে বাবা নামছি আমি, আসতে ১০ মিনিট লাগবে।”
“তিন্নি তুই আবারও লেট!” ওর গলায় সুস্পষ্ট অভিযোগ, কিন্তু এক মুহূর্ত পরেই অভিযোগ সরে গিয়ে উৎসাহ চলে এল, “কিন্তু গেজ হোয়াট? আমি আজ তোকে বাঁচাতে চলে এসেছি। নিচে নাম এখনই। আমি উবার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।”
ওকে, সারপ্রাইজড হতে আমার ভালো লাগে বেশ, আমার মেয়ে বন্ধুগুলোর মধ্যে এই বৃষ্টিই এসব উদ্ভট সারপ্রাইজ দেয় আমাকে। ওর বাসা এখান থেকে ঘুরপথ হয় নিউমার্কেট হিসেব করলে। তারমানে সে ইচ্ছে করেই এটা করেছে। এমন না যে মাঝপথে তুলে নিচ্ছে আমাকে।
“কেন যে এসব করিস”, গাড়িতে উঠতে উঠতে বললাম আমি। সে দরজা খুলে প্রফেশনাল বাটলার স্টাইলে দাঁড়িয়ে ছিল আমার জন্যে।
২
মিডিয়া শখের জায়গা হলেও আমি আমার ফেয়ারনেস নিয়ে মোটামুটি সচেতন। তাই খাবার খুব বেছে খাই আমি। কিন্তু নিউমার্কেট যে একটা নেশার নাম। তাই উল্টোপাশে গাউছিয়ার ওপাশে যে দোকানটা ওখানকার স্ন্যাকস খাবো না সেটা হতে পারে না। সেটা খেয়ে বিল দিতে গিয়ে টের পেলাম তারাহুড়ায় আমি পার্স রেখে চলে আসছি। এই সেরেছে! পাশে অভি দাঁড়িয়েছিল, আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেলের সবচেয়ে বড়লোক ছেলে। তিনটা ব্যবসা সামলায়, এরমধ্যে দুইটাই বাবার। কিন্তু তিন নম্বরটা নিয়েই ওর বেশি তাড়া, ও নিজের গার্লফ্রেন্ডের সাথে মিলে দাঁড় করাচ্ছে। বাকি দুটো থেকে যে পয়সা পায়, আমাদের সার্কেলে অধিকাংশ আউটিং এ সিংহভাগ ও জোর করেই কনট্রিবিউট করে। বেচারাকে প্যারা দেওয়া হবে না টাকা চাইলে তাই ওর কাছে ধার চাব ভেবে রাখলাম। আপাতত ওকে বিলটা দিতে দেই তবে। “দোস্ত, এই ট্রীটটা তো আমার দেওয়ার কথা, কিন্তু আমি ভুলে গেছি রে টাকা আনতে। তুই দিয়ে দিবি একটু?” ওপাশে গিয়ে ব্যাগ কেনার সময় টাকা চেয়ে নিব ওর কাছ থেকে। ফ্রেন্ডশীপ ডে তে আমরা মেয়েরা একই রকম ব্যাগ নিয়ে বের হব। তাই আজকের শপিং। আজীবন ভিড় লেগে থাকা ওভারব্রিজটা পার হয়ে ওপারে গেলাম। ব্যাগ পছন্দ করলাম। অভির কাছে চাইতে যাব ব্যাগ কেনার সময়, ওমা! পিছে ফিরে দেখি বৃষ্টি হাতে দুটো ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। “তোর দেওয়া লাগবে না, আমি কিনে ফেলেছি।” আমি অবাক হয়ে গেলাম, অনেক জোর জবরদস্তি করে ওকে বললাম এইটা ধার। ও হাসি দিয়ে বলল, “অবশ্যই!”
৩
ফ্রেন্ডশীপ ডে! আজ আমাদের সেই বহুল প্রতীক্ষিত আউটিং। সবাই মিলে মুভি দেখব আর তারপর টি এস সি যাব চা খেতে। এই দুটো কাজই আমরা বছর দুয়েক আগে নিয়মিত করতাম। ইদানিং আর করা হয়না কিন্তু আমরা খুব খুব মিস করি, তাই বন্ধু দিবসে আজ এ দুটো কাজই করব ঠিক করেছি। আমি সুপারহিরো মুভির বিশাল ভক্ত! আর ডেডপুল আমাদের সবারই ক্রাশ। মুভি দেখে হাসতে হাসতে বের হলাম। মনটা খুব ভালো আজকে আমার। আজ ওদের সাথে শেয়ার করব আমি আমার বিগ নিউজ টা।
মরিচ চা হাতে নিয়ে সবাইকে গোল হতে বললাম আমি।
“দোস্তরা, আই হ্যাভ আ বিগ নিউজ টু শেয়ার।”
সবাই স্থির দাঁড়িয়ে পড়ল।
“কী, আরেকটা টিভি চ্যানেলে শো হবে নাকি?” প্রমিতা বলল। ও আমাদের আরেক বান্ধবী।
“নাকি কোন মিলিয়নিয়ার প্রপোজ করল?” অভি খোঁচা মারল।
“উমম, এন্ড আই সেইড ইয়েস। আগামী শুক্রবার আসবে রিং পরাতে” আমি ফস করে বলে বসলাম।
“হোয়াট?”
“ওহ মাই গড”
“বলিস কী!”
“কী করলি তিন্নি!”
“কনগ্রাচুলেশন!”
আমাকে নিয়ে মোটামুটি উৎসব শুরু হয়ে গেল, আমার মনে নাই কে আমাকে নিয়ে কী টানাটানি করেছে এরপরের ১০ মিনিটে। আধা ঘণ্টা পর যখন সবাই বিদায় নিচ্ছে আমাকে বারবার বলে গেল যে বিশাল ট্রিট পেন্ডিং, কারণ আমি মিলিয়নিয়ার জামাই পাচ্ছি। আমি ছেলেটাকে বেশিদিন ডেট করিনাই। কিন্তু আমি মানুষ চিনতে ভুল করিনাই কখনও। ও আমাকে অসম্ভব পছন্দ করে, আর আমিও ওকে। তাই প্রপোজ করামাত্র রাজি হয়ে গিয়েছি। বাসায় ও ঠিকথাক সব। আমার রূপকথা শুরু হচ্ছে অবশেষে।
সবাই বিদায় নিচ্ছে, এই মুহূর্তে ও কল দিল। আমাকে টি এস সি থেকেই পিক করার কথা। কিন্তু একটা ইমারজেন্সি মীটিং পড়ে গেছে জার্মান পার্টনারের সাথে। রিজেন্সিতে আরও আধা ঘণ্টা লাগবে ওর। তারপর আসতে আরও ৪৫ মিনিট। এই সোয়া ঘণ্টা কী করব আমি?
“কীরে, হাতে সময় আছে নাকি তোর?” বৃষ্টির টোকায় বাস্তবে ফিরলাম আমি। “হ্যাঁ, ওর নিতে আসার কথা আমাকে, কিন্তু সময় লাগবে আরেকটু। তোরা সবাই তো চলে যাবি মনে হচ্ছে।”
বৃষ্টি মাথা নাড়ল, “তোর জন্যে সবসময় সময় আছে আমার, তিন্নি। চল, হলে চল। আমার রুমে রেস্ট করি।” ও পলিটিক্স করে, বিশাল নেত্রী। হলে তাই সবসময়ই জায়গা থাকে ওর। রিক্সায় উঠার পর আমার মনে হল কিন্তু একটা গড়বড় আছে, ও কেমন চুপচাপ।
“এই বৃষ্টি, কী হয়েছে তোর?”
“নাহ কই কিছু না তো।”
“তাহলে চুপচাপ কেন এত তুই?”
আমার কেন জানি মনে হল সবাই যখন আমাকে নিয়ে নাচানাচি করছিল এর মধ্যে বৃষ্টি ছিল না। কিন্তু আমি এই অদ্ভুত ভাবনাটা কেন ভাবব? বেশি ভাবছি আমি। কিন্তু আবার, মানুষ চিনতে তো কখনোই আমার ভুল হয় না।
“আরে ধুর, শরীর খারাপ লাগছে একটু”, বৃষ্টির কথায় ঘোর ভাঙল আমার।
“তাহলে আমি তকে জ্বালাচ্ছি কেন? তুই হলে গিয়ে রেস্ট নে, আমি টি এস সিতেই বসি, সময় কেটে যাবে।”
“আরে না না! কী বলিস, চল তো! তুই থাকলেই বরং ভাল লাগবে।”
আমি আবারও কনফিউজড হয়ে গেলাম।
সন্ধ্যে নেমেছে আগেই।
কিন্তু বৃষ্টির ঘরটা এত বেশি অন্ধকার কেন লাগছে আমি বুঝতে পারছি না।
এই অদ্ভুত মোমবাতিটা আলোর চেয়ে বেশি আঁধার ডেকে আনে বোধহয়? ছিপছিপে গড়নের মোমের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম আমি। হুট করে আমার ঘাড়ে কিছু একটার স্পর্শ পড়ল। আমার পুরো শরীর চমকে উঠল। এটা মানুষের আঙ্গুল নয়।
এত নরম স্পর্শ একটা জিনিসেরই হয়।
ঠোঁট।
বৃষ্টি পেছন থেকে শক্ত করে চেপে ধরল আমাকে আর ঠোঁট দুটো আরও চেপে বসল আমার ঘাড়ে। ওর হাত দুটো আমার বুকের কাছে আসা মাত্রই আমি লাফিয়ে উঠলাম।
আমার চোখে রাজ্যের অবিশ্বাস। কিন্তু এই আলো আঁধারির মাঝে বৃষ্টি সেটা দেখতে পাচ্ছে না।
“তুই এ কী করছিস বৃষ্টি?” আমার গলা কাঁপছে।
“আমি তোকে ভালোবাসি তিন্নি। তুই জীবনে যে কয়টা গান গেয়েছিস, সবগুলোর সুরের বাঁক আমার মুখস্ত। তোর প্রত্যেকটা ছবিতে কয়টা ভাঁজ আছে আমি চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারব।”
আমার মনে হচ্ছে আমি কোন স্বপ্ন দেখছি।
“কিন্তু তুই… তুই… আমি তো স্ট্রেইট, বৃষ্টি। আমার এঙ্গেজমেন্ট শুক্রবার।”
“ক্যান্সেল কর ওটা!”, হিসিয়ে উঠল ও। লাফিয়ে এসে পড়ল আমার ঠিক সামনে এক ইঞ্চি দূরত্বে। আমি জমে গেলাম জায়গায়। ও আঙ্গুল দিল আমার ব্লাউজের ঠিক উপরের শাড়ির জায়গাটাতে। আমি ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে দৌড়াতে গেলাম, ও আমার চুল ধরে টান দিয়ে নিয়ে আসল ওর কাছে। আমার কানে ওর ঠোঁট চেপে চাবিয়ে চাবিয়ে বলল, “এতগুলো বছর… এত্ত ভালোবাসলাম, তুই কিচ্ছু টের পেলি না? আজ বললাম আর তুই এই রিএকশন দিলি?”
আমি ব্যথা পাচ্ছিলাম খুব। চোখে পানি চলে আসল।
“ছেড়ে দে বৃষ্টি! তুই আমার বান্ধবী, আর আমি স্ট্রেইট। তুই যা চাচ্ছিস তা সম্ভব না। আই লাভ হিম।”
বাঁধন আলগা হয়ে গেল। আমি টের পেলাম এটাই সুযোগ। দৌড়ে গেলাম দরজার কাছে।
দরজায় তালা।
“তুই ওকে এতই ভালোবাসিস যে আমার ভালোবাসা থেকে এভাবে দৌড়ে পালাতে হবে তোর?” বৃষ্টির গলার স্বর একেবারে ঠাণ্ডা। “কেন যেসব মেয়েকে আমি ভালোবাসি তারা আমার সাথে এমন করে সবসময়? কী আছে ওই ছেলেদের মধ্যে বল তো? দেখ এইযে,” খাতের নিচ থেকে কী যেন একটা বের করল ও, “এইখানে ওর রক্ত আজও লেগে আছে জানিস? চার বছর আগের প্রেম আমার। জুনিয়র ছিল। এত্ত ভালোবাসলাম। হলে জায়গা দিলাম। ডিবেট ক্লাবের এক নম্বর টিমে ঢুকালাম। ট্রফি জিতালাম পার্শিয়ালিটি করে। কিন্তু, আমায় ভালোবাসে নাই। কী করিনাই ওর জন্যে বল? শেষমেষ অন্য পার্টির চর বলে চালিয়ে গাপ করে দিতে হল র্যাগের নাম করে। কে জানত তুইও এমনই করবি আমার সাথে?”
মোমবাতির আলোটা কি খুব বেড়ে গেল হুট করে? নাহলে মাথার উপর লোহার ধাতব পাইপের বাড়িটা পরার আগ মুহূর্তে আমি যে কালচে রক্ত দেখতে পেলাম পাইপে, সেটা কি ভুল দেখেছি?
মরার আগ মুহূর্তে মানুষ অনেক কিছুই দেখে। সব বিশ্বাস করতে হয়না।
-ইতস্তত বিপ্লবী
২৪ মার্চ ২০২০
(গল্পের চরিত্র, ঘটনা সবই কাল্পনিক। জীবিত বা মৃত কারো সাথে কোনকিছু মিলে গেলে লেখক দায়ী নন)